মুমিনুলের দিন
ডিটেকটিভ স্পোর্টস ডেস্ক
রানের ফোয়ারা ছুটছে। মাইলফলক আর রেকর্ড ধরা দিচ্ছে। দিনটি হয়ে উঠছে স্বপ্নময়। হঠাৎই শেষ বেলায় একটু বিষাদের ছোবল। জোড়া ধাক্কার অস্বস্তি। তবে আলোর ঝিলিক তাতে খুব একটা ম্লান হয়নি। দিন শেষেও যে জ¦লজ¦ল করছে মুমিনুল হকের ব্যাট!
দিনটি মুমিনুলের, দিনটি বাংলাদেশের। সেঞ্চুরি খরা কাটানোর দিন, অনেক ক্ষোভ আর অভিমানের জবাব দেওয়ার দিনে অসাধারণ ব্যাট করে মুমিনুল অপরাজিত ১৭৫ রানে। প্রথম দিনে বাংলাদেশের রান ৪ উইকেটে ৩৭৪।
টেস্ট ক্রিকেটে দেড় যুগের পথচলায় প্রথম দিনে বাংলাদেশের এটিই সর্বোচ্চ রান। আগের সর্বোচ্চ ছিল ৩৬৫। সব দিন মিলিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ।
রেকর্ড গড়া দিনের মেরুদ- রেকর্ড গড়া এক জুটি। তৃতীয় উইকেটে বাংলাদেশকে প্রথম দুইশ রানের জুটি উপহার দিয়েছেন মুমিনুল ও মুশফিকুর রহিম। তবে এই জুটির ভাঙন যেভাবে, সারাদিনে বাংলাদেশের সবচেয়ে আক্ষেপের প্রহরটুকুর জন্মও সেখানেই।
দিনের শেষ বেলায় সেঞ্চুরির কাছে গিয়ে আউট হয়ে গেলেন মুশিফক। ব্যক্তিগত অর্জন হারানোর আক্ষেপের রেশ না মিলাতেই দলের জন্য আরেকটি ধাক্কা। পরের বলেই বল ছেড়ে দিয় বোল্ড লিটন দাস।
তার পরও দিনশেষে অনেকটা এগিয়ে বাংলাদেশ মুমিনুল টিকে আছেন বলেই। তার সঙ্গে শেষ সময়টুকু কাটিয়ে দিয়েছেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। দিনের শুরুতে ভাগ্যটাকেও পক্ষে পেয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। প্রথম টসেই জয়। ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মাহমুদউল্লাহর চেহরায় ছিল যে আত্মবিশ্বাসের ছাপ, সেটিই অনূদিত হয় তামিম ইকবালের ব্যাটে। ম্যাচেই দ্বিতীয় ওভারেই লাহিরু কুমারাকে মারেন টানা তিনটি বাউন্ডারি।
ম্যাচের আগে উইকেট স্পিনস্বর্গ হবে বলে ধারণা করা হলেও প্রথম দিনে ছিল দারুণ ব্যাটিং সহায়ক। তামিমের ব্যাটে শুরুর সেই দ্যুতি ছিল পরের ওভারগুলোতেও। পেস বলে খেলেছেন দারুণ সব ড্রাইভ। স্পিনে উড়িয়ে মেরেছেন ছয়।
আরেকপাশে ইমরুল ছিলেন টিকে। তামিমের সৌজন্যে জুটির পঞ্চাশ এসে দশম ওভারেই। দশ ইনিংসে বাংলাদেশের উদ্বোধনী জুটির প্রথম ফিফটি জুটি। তামিমের পঞ্চাশ ৪৬ বলে।
তামিমের সম্ভাবনাময় ইনিংসটি থামে ফিফটির পরপরই। দিলরুয়ান পেরেরার দারুণ একটি বল আর তামিমের ক্ষণিকের অমনোযোগ, ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড।
বাংলাদেশের রানের ¯্রােত তাতে থামেনি। তামিমের বিদায়ে একটু জেগে ওঠেন ইমরুল। মুমিনুল শুরু থেকেই সাবলীল। ২০ ওভারেই দল পেরিয়ে যায় একশ।
তবে তামিমের মত শুরুটাকে বড় করতে পারলেন না ইমরুলও। বিরতির আগে বাংলাদেশের উইকেট হারানোর পুরোনো ধারাকে ধরে রেখে লাঞ্চের আগের ওভারে আউট বাঁহাতি ওপেনার। অন্য প্রান্তে মুমিনুলের সঙ্গে কথা বলেও এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্তে রিভিউ নিলেন না। টিভিতে বল ট্রাকিংয়ে দেখা গেল, বল চলে যেত স্টাম্পের ওপর দিয়ে!
সেই হতাশা বাংলাদেশ ঝেড়ে ফেলে দ্রুতই। মুমিনুলের নান্দনিকতা আর মুশফিকের দৃঢ়তায় ছোটে রানের রথ। পঞ্চাশ, শতরান পেরিয়ে দুজনের জুটি একসময় গড়ে ফেলে বাংলাদেশের রেকর্ড। পেছনে পড়ে যায় ১৫৭ রানের আগের রেকর্ড। ছাড়িয়ে যায় দুইশ রানও।
এই পথচলাতেও রচিত হয় আনন্দদায়ক সব গল্প। ৯৬ বলে মুমিনুল স্পর্শ করেছেন সেঞ্চুরি। প্রথম ১২ টেস্টেই ৪ সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যান পঞ্চম সেঞ্চুরিটি পেলেন ১৩ টেস্ট অপেক্ষার পর! বাংলাদেশের হয়ে এটি দ্বিতীয় দ্রুততম সেঞ্চুরি।
তার চোখধাঁধানো সব শটকেও ছাড়িয়ে গেল সেঞ্চুরির উদযাপন। বরাবরই পরিমিত মুমিনুল এদিন সেঞ্চুরির পর ছিলেন দারুণ খ্যাপাটে। সাবেক কোচ চন্দিহা হাথুরুসিংহের পুরো সময়টাতে মুমিনুল ছিলেন নানাভাবে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। সাবেক কোচের বর্তমান দলের বিপক্ষে প্রথম সুযোগেই নিজের জাত চিনিয়ে মুমিনুল ব্যাটের মতো জবাব দিলেন হয়তো উদযাপনেও।
পরে গড়েছেন বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম ২ হাজার রানের রেকর্ডও। দল তখন অপেক্ষায় আরেকটি মাইলফলক উদযাপনের। সেঞ্চুরির দুয়ারে কড়া নাড়ছিলেন মুশফিক।
শ্রীলঙ্কা তখন নিয়েছে দ্বিতীয় নতুন বল। একটু একটু করে মুশফিককে অফ স্টাম্পের বাইরে টেনে আনছিলেন সুরাঙ্গা লাকমল। শেষ পর্যন্ত ফাঁদে পা দিয়েই স্টাম্পের একটু বাইরের বলে ব্যাট ছুঁইয়ে মুশফিক আউট ৯২ রানে।
দুজনের জুটি থামল ২৩৬ রানে। সব জুটি মিলিয়ে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ জুটি। শেষ বেলায় নাইটওয়াচম্যান না নামিয়ে বাংলাদেশ নামায় লিটন দাসকে। কিন্তু লাকমলের অফ স্টাম্পে থাকা বল পা বাড়িয়েও ছেড়ে দিলেন লিটন। কী ছিল তার মনে, কে জানে! উড়ল বেলস, উল্লাসে মাতল লঙ্কানরা।
পরের সময়টুকুতে অস্বস্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর বিপদ হয়নি। দিনজুড়ে যেমন ছিলেন, মুমিনুল শেষটাও করেছেন দারুণ নির্ভরতায়। নামের পাশে অপরাজিত ১৭৫। ২০৩ বলের ইনিংসে ১৬টি চার, ১টি ছক্কা। এই দিনে যেন আউট হতে পারতেনই না মুমিনুল!
মুমিনুল আছেন বলেই আড়াল হচ্ছে শেষের ওই জোড়া ধাক্কা। মুমিনুল ছুটছেন বলেই বেঁচে দলের আরও বড় স্কোরের আশা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৯০ ওভারে ৩৭৪/৪ (তামিম ৫২, ইমরুল ৪০, মুমিনুল ১৭৫*, মুশফিক ৯২, লিটন ০, মাহমুদউল্লাহ ৯*; লাকমল ১৭-৩-৪৩-২, কুমারা ১২-১-৬৪-০, দিলরুয়ান ২৪-৪-৯৮-১, হেরাথ ২০-১-১০০-০, সান্দাকান ১৩-১-৫৮-১, ধনঞ্জয়া ৪-০-১১-০)